সুগন্ধী কস্তুরী বা মেশক: মুখলিস ও তাসাউফের শিক্ষা
আল্লাহর হাবীব রসুলুল্লাহ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা ﷺ সুগন্ধী হিসেবে মেশক (মিস্ক/مِسْك/musk /musc/মৃগনাভী) বা কস্তুরি ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করেন। লক্ষণীয় বিষয় হল যে হুযুর আকরাম ﷺ এর নিজ দেহ মুবারক থেকেও মেশকের সু্ঘ্রাণ সব সময় পাওয়া যেত। সাহাবায়ে কেরাম যদি কখনও তাঁর ﷺ থেকে পেছনে পড়ে যেতেন পথ চলার সময় অথবা তাঁকে দৃষ্টিসীমায় দেখতে না পেতেন তবে তাঁর ﷺ পবিত্র শরীর মুবারকের ঘ্রাণ তাদেরকে দিক নির্দেশনা প্রদান করত।
কস্তুরি বা মেশক বা মৃগনাভী-এর দুই একটি দিকে বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। মেশক একটি বিশেষ প্রজাতির পুরুষ হরিণের দেহের অভ্যন্তরে গ্রন্থীতে (gland, pod) ক্ষরণ (secretion) থেকে তৈরী হয়। এই হরিণটির রূপ ও গুণ লক্ষণীয়।
১। হরিণটির দুই দিকের দুইটি দাঁত বড় হয় (fang) এবং মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে থাকে, কাজেই তার মুখটি দেখতে তত সুন্দর হয় না।
২। হরিণটি হয়ে হয়ে থাকে লাজুক স্বভাবের।
হরিণটি যখন যৌবনপ্রাপ্ত হতে থাকে তখন তার মুত্রথলীর কাছে এই গ্রন্থীতে ক্ষরণ হয়ে রক্ত বিন্দুর রঙের কালচে লাল সুঘ্রাণময় কণা জমা হয়। হরিণের ভেতরে মেশকের বা কস্তুরীর ঘ্রাণ এমন প্রবল হয় যে তার দেহের ত্বক ভেদ করে সুবাস ছড়াতে থাকে। এই ঘ্রাণে নারী হরিণ তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
হরিণের দেহের মেশকের ঘ্রাণের চমৎকার যে বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল ঘ্রাণ ছড়াতে থাকলে হরিণটি বুঝতে পারে না যে ঘ্রাণের উৎস কোথায়। সে বরং ঘ্রাণের উৎসের খোঁজে এদিক ওদিক যায়। অথচ ঘ্রাণ তার নিজের দেহ থেকেই যে আসছে এই চেতনা তার হয় না। সে এমনই নিষ্পাপ ও নিজের বিষয়ে এমন বেখবর।
হরিণের দেহ থেকে এই গ্রন্থি বের করার জন্য তার শরীরে ছুরি চালাতে হয়–হরিণটিকে প্রাণ দিতে হয়। মানুষ সেই গ্রন্থি থেকে সুগন্ধী প্রস্তুত করে।
আল্লাহ কুরআনুল করিমে একটি গাভীর রূপক দিয়ে বলেছিলেন যে,
وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً ۖ نُّسْقِيكُم مِّمَّا فِي بُطُونِهِ مِن بَيْنِ فَرْثٍ وَدَمٍ لَّبَنًا خَالِصًا سَائِغًا لِّلشَّارِبِينَ
তোমাদের জন্যে চতুস্পদ জন্তুদের মধ্যে চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই তাদের উদরস্থিত বস্তুসমুহের মধ্যে থেকে গোবর ও রক্ত নিঃসৃত দুগ্ধ যা পানকারীদের জন্যে উপাদেয়। [নাহল: ৬৬]
এই হল মুখলিস-এর স্বভাব। তার ভেতর যাইই থাকুক সে অপরকে তার মিষ্টতা ও সুবাস বিতরন করবে। হরিণটিও তাইই করছে। তার উদরে থাকা গ্রন্থি থেকে সে সুবাসিত কস্তুরি দিচ্ছে। সে নিজের সুগন্ধীময় গোপনীয়তাকে মানুষের জন্য বিতরণ করার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয় এটি সবিশেষ লক্ষণীয়। কস্তুরি বা মেশক কেবল আতর তৈরীতেই ব্যবহৃত হয় না, ঔষধ হিসেবেও মানুষ গ্রহণ করতে পারে।
দেখতে অন্য হরিণ প্রজাতি সমূহের তুলনায় ততটা আকর্ষণীয় মুখশ্রীর না হলেও হরিণটির দেহের ভেতর তৈরী হয় সুঘ্রাণময় কস্তুরি। রূপ কেমন তার চেয়ে এখানে তার ভেতর কী গুণ আল্লাহ দান করেছেন তা লক্ষণীয়।
তার স্বভাবের লাজুকতা খুব লক্ষণীয়।
সে যে নিজের গুণপনা নিয়ে বেখবর তা লক্ষণীয়।
সুবাস নিয়ে চলেও সে অহংকারী হয় না, বরং লাজুক স্বভাব ধারন করে।
আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে আমরা আল্লাহকে এই হরিণটির মত পুরো জগতে খুঁজে বেড়াই। অথচ আল্লাহ বলছেন,
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ
আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী।
[ক্বাফ: ১৬]
ইসলামী সংস্কৃতিতে সুগন্ধী কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
হুযুর ﷺ বলেছেন যে তিনি
حُبِّبَ إِلَىَّ مِنَ الدُّنْيَا النِّسَاءُ وَالطِّيبُ وَجُعِلَ قُرَّةُ عَيْنِي فِي الصَّلاَةِ
পৃথিবীতে আমার নিকট প্রিয় করা হয়েছে নারী ও সুগন্ধীকে, এবং সালাতকে (নৈকট্য, প্রার্থনা) আমার জন্য প্রশান্তির (চোখের প্রশান্তি) করা হয়েছে।
[নাসাঈ ৩৯৩৯, বই ৩৬, হাদিস ১]
কারণ, সুগন্ধী কেবল দেয়, সে বিনিময় প্রত্যাশা করে না। সে একটি বিসর্জনের ফল। সে নিষ্পাপতার ফসল। সে অহংকারহীনতা, লাজুকতার নির্যাস।
নারী নিজের গর্ভকে (রেহম) প্রসারিত করে জন্মদান করে।
নৈকট্য তখনই অর্জিত হয় যখন কেউ বিসর্জন দিতে কিংবা ত্যাগ করতে পারে। এসব গুণ যখন জমে ওঠে তখন কস্তুরীর মত সুগন্ধীতে রূপ পায়।
মাওলানা জালালউদ্দিন রূমী বলেন,
এ তরল তো রক্ত জাহেরীতে: তবে সে কেমন করে
হরিণের গ্রন্থিতে রূপ পেল মেশকের সুবাসে?
تو مگو کاین مایه بیرون خون بود ** چون رود در ناف مشکی چون شود
মসনবী শরিফ ১: ১৪৭১
মাওলানা জালালউদ্দিন রুমী রহমতুল্লাহি আলাইহি